মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ...!!!

11/01/2012 19:01

একটি ভাষার ক্রমে ক্রমে লোপ হয় যখন সেটি সমসাময়িক কালের দৈনন্দিন ব্যবহৃত ভাব এবং বস্তুকে নিজস্ব শব্দ সংগ্রহ দিয়ে বর্ণনা করতে পারে না।মানব-ঐতিহ্যের জন্য ভাষার বৈচিত্র্য অন্যতম শর্ত। কারণ প্রতিটি ভাষার মাঝে লুকিয়ে আছে সেই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর অসামান্য সাংস্কৃতিক প্রজ্ঞা। সঙ্গত কারণে কোনো ভাষার মৃত্যু বা হারিয়ে যাওয়ার সহজ-সরল অর্থ হচ্ছে, তা পুরো মানবজাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। একটি ভাষার মৃত্যু অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। ইতিহাসের নানা বাঁকে নানা সম্প্রদায় কালের গর্ভে চলে যায় নানা কারণে। হারিয়ে যায় তাদের ভাষাও। ওল্ড টেস্টামেন্টের যুগে সভ্যতার পতনের সঙ্গে সঙ্গে ‘হিট্টাইট’ ভাষাও মরে যায়। পৃথিবীতে ভাষার মৃত্যু নিয়ে তখন উদ্বেগ কেমন ছিল, তা গবেষণার বিষয় হতে পারে। কিন্তু বিশ্বায়নের ধাক্কায় এখন অনেক ভাষাই ধারাবাহিকভাবে হারিয়ে যাবে—এই উদ্বেগ ভাষাতাত্ত্বিকদের আজ বেশ নাড়া দিচ্ছে।ভাষার মৃত্যু হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া, যা কোনো নির্দিষ্ট ভাষাভাষী জনগণের ভাষাগত দক্ষতাকে কমাতে কমাতে শূন্যে নামিয়ে আনে।

'ভাষার পূর্ণ মৃত্যু' তখনই ঘটে, যখন সে ভাষা ব্যবহার করার মতো শেষ মানুষটিও মৃত্যুবরণ করে। শেষ 'নেটিভ স্পিকার'-এর মৃত্যু একটি ভাষা ও সংস্কৃতির মৃত্যুর সমার্থক। এ মৃত্যুর মানে একটি ভাষা-সম্প্রদায়ের নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। ব্যাপক অর্থে যখন 'ভাষার ক্ষতি' আলোচনা করা হয়, দুটি বিষয় বিবেচনায় আনা হয়। যেমন_ বাংলা ভাষার ক্ষতি আলোচনায় প্রথমে হিসাব করা হবে বাংলা যাদের প্রথম ভাষা তাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে ক্ষতি ও সম্প্রদায়গত ক্ষতি এবং বাংলা যাদের দ্বিতীয় ভাষা তাদের ক্ষতি। এ ক্ষতিটির প্রকৃতি ভিন্ন_ ভাষার ক্ষতি যা অপরিমেয় এবং ভাষার ক্ষতির কারণে সৃষ্ট ক্ষতি, তাও অপরিমেয়।

ভাষার মৃত্যুর কয়েকটি ধরন
ধীর মৃত্যু : এটিই সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত প্রক্রিয়া। এতে বিভিন্ন আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক কারণে একটি নির্দিষ্ট ভাষার জনগোষ্ঠী পার্শ্ববর্তী একটি অঞ্চলের প্রভাবশালী ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়ে মাঝখানে একটি দ্বি-ভাষিক অন্তর্বর্তীকালীন পর্ব থাকে তারপর এই 'বাইলিঙ্গুয়ালিজম' অপসৃত হয়; নতুন ভাষাটিই তাদের ভাষা হয়ে ওঠে। অস্ট্রিয়ার একাংশের হাঙ্গেরিয়ান ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে নিজ ভাষা ছেড়ে জার্মানকে বরণ করে নিয়েছে। ২০০৯ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রোমানিয়ান ঔপন্যাসিক হের টা মুলার রোমানিয়ান ও জার্মান দুই ভাষাতে লিখছেন, তার পরের প্রজন্ম যারা এখন জার্মানিতে অভিবাসী, তাদের কাছে রোমানিয়ান বিস্মৃত এক ভাষা।
মূল থেকে মৃত্যু : এটি 'বটম টু টপ ল্যাঙ্গুয়েজ ডেথ'। এ ক্ষেত্রে ব্যবহারিক জীবনে ভাষাটি তার উপযোগিতা হারায়। নিত্যকার ব্যবহারিক স্তরে এ ভাষার ব্যবহার কমতে কমতে এক পর্যায়ে হয়তো ধর্ম প্রতিষ্ঠানের ওপর আশ্রয় করে, তারপর কেবল ইতিহাস গ্রন্থে ও গবেষণা স্তরে। এর বড় উদাহরণ লাতিন। সংস্কৃতের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
দ্রুত মৃত্যু : এটি র‌্যাডিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ ডেথ; খুব অল্প সময়ের মধ্যে একটি ভাষার বিস্মৃত হওয়ার নজির এস্কিমোদের ভাষা।
সহসা মৃত্যু বা ভাষা হত্যা : এক সকালে ঘুম থেকে উঠে বসলেন, মা নাস্তা দাও, খাব। কোনো উত্তর এলো না। সবিস্ময়ে দেখলেন বাংলা ভাষায় এই কথার জবাব দেওয়ার মতো আর একজন মানুষও জীবিত নেই। তাসমেনিয়া, অস্ট্রেলিয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। একটি ছোট শিশুকে তার বাবা-মার কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির জালে আটকে রাখলে, মূল ভাষা থেকে সেও বিচ্ছিন্ন হলো, প্রবেশাধিকার না থাকায় ভাষার কাছে সেও মৃত। ইডিশের মৃত্যুর কারণ হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প।
র‌্যাডিক্যাল ডেথ : এস্কিমোদের একটি একদা জীবন্ত ভাষার নাম সাইরেনিকস্কি, যা 'ওল্ড সাইরেনিক' নামে পরিচিত, মাত্র ৬৫ বছরের ব্যবধানে ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই অবলুপ্তি বা মৃত্যুর পর্বটি শুরু হয় ১৮৯৫ সালে এবং শেষ হয় ১৯৬০ সালে। সাইবেরিয়ান এস্কিমোরা একটি দ্রুত প্রক্রিয়ার মধ্যে কয়েকটি ধাপে তাদের নিজস্ব ভাষাটি হারায়। সাইরেনিকস্কি ভাষা বিলুপ্তির চারটি পরস্পর সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রাইগর ত্রুক্রপনিক :
ক. অধিক সংখ্যক মানুষের ব্যবহৃত অন্য একটি এস্কিমো ভাষা সাইরেনিকস্কি সরিয়ে সে স্থান অধিকার করে নেয়।
খ. বহিরাগত শাসকগোষ্ঠী শাসনের সুবিধার্থে অধিক সংখ্যক মানুষের ভাষাকে দাফতরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করায় সাইরেনিকস্কি উপেক্ষিত হতে থাকে।
গ. দুই ভিন্ন ভাষাভাষী এক্সিমো জনগোষ্ঠী যখন একই শাসনের আওতায় একীভূত হলো দুর্বল ও অনাদৃত ভাষাটি বিলুপ্ত হতে শুরু করল।
ঘ. একটি ভাষা চালু রাখার জন্য যে নির্দিষ্ট প্রজনন স্তর রাখা দরকার, সংখ্যাগতভাবে তা অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় সাইরেনিকস্কি বিলুপ্ত হয়ে গেল।
অন্য একটি ভাষার দৌরাত্ম্যে অপসৃত হওয়ার প্রধান কারণ সাইবেরিয়ান এস্কিমোরা চাপিয়ে দেওয়া ভাষাটি গ্রহণ করেছে কয়েকটি ধাপে_
ক. কন্টাক্ট বাইলিঙ্গুয়ালিজম এই স্তরে দ্বিতীয় ভাষার সঙ্গে সান্নিধ্য সৃষ্টি হলো।
খ. পরবর্তী স্তরে নর্মেটিভ বাইলিঙ্গুয়ালিজ_ এই স্তরে মান নির্ধারক সংস্রব তৈরি হলো।
গ. রুটিন বাইলিঙ্গুয়ালিজম_ এই স্তরে দ্বিতীয় ভাষাটি ব্যবহারিক প্রয়োজনের হাতিয়ার হয়ে উঠল।
ঘ. শেষ স্তরে রেসিডিউয়াল বাইলিঙ্গুয়ালিজম_ প্রথম ভাষাটি কেবল স্মৃতিতে, ইতিহাসে, লিখিত দলিলে টিকে থাকল।
একটি ভাষার মৃত্যু ঘটা মানে হল পৃথিবী থেকে একটা ইতিহাসের মৃত্যু, একটা জনগোষ্ঠীর যা কিছু অর্জন, সঞ্চয়, সভ্যতা সবকিছুর হারিয়ে যাওয়া।যখন একটি ভাষা মৃত্যুবরণ করে তার মানে কেবল এই নয় যে একটি অভিধানের মৃত্যু হলো। আসলে সেই সঙ্গে একটি সভ্যতারই মৃত্যু হয়। যে ভাষাটির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা একটা সমাজের সংস্কৃতির ইতিহাস ও জ্ঞানের মূল্যবান সব তথ্য উপাত্ত চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। এটা বড়ই বেদনাদায়ক ।

আমদের দেশে বর্তমানে এক জাতীয় ভাষার যা তথাকথিত ধনী শ্রেণীর মুখে শোনা যায়, যাকে বলা যায় বাংরেজী ( শব্দ বাংলা উচ্চারণ ইংরেজি ) ।যা শুনতে শ্রুতিকটু লাগলেও এটাই এখন আধুনিকতা। আমরা একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি রক্ত দিয়েছি। আমাদের সেই একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আসুন আমরা সবাই আমাদের মাতৃভাষাকে বাংরেজি উচ্চারণে নয় শুদ্ধ উচ্চারণে উচ্চারণ করি।
বাংলা ভাষার ব্যাপক ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে একটি দুঃখজনক বিষয় নজরে পড়ে, তা হচ্ছে বাংলা বানান ও উচ্চারণে চরম বিশৃঙ্খলা। বাংলা বানান নিয়ে বিভ্রান্তি দিনে দিনে বাড়ছে, বানানের নিয়মকানুন যে প্রতিদিন বদলাচ্ছে তা নয়; বানান আয়ত্ত করার বিষয়ে আমাদের ঔদাসীন্য ও অবহেলা বাড়ছে, বাড়ছে এক ধরনের হঠকারিতাও। যে কারণে সাহিত্যকর্মের বাইরে পোস্টারে বিজ্ঞাপনে, সাইনবোর্ড ও সংবাদপত্রের পাতায়, বেতার-টেলিভিশনে এই ভুলের বিপুল পরিচয় পাওয়া যায়।ভাষার বানান যত্ন করে শিখতে হয়, বাংলা ভাষায় ভুলের যে নৈরাজ্য চলছে তাতে বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা ও ঔদাসীন্যই প্রকাশ পায়। ভাষা ব্যবহারে অশুদ্ধির একটি কারণ উচ্চারণ দোষ, আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণ প্রভাব থেকে অনেকেই মুক্ত হতে পারেন না। অন্যদিকে শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণের প্রতিও সতর্ক থাকেন না। এই উচ্চারণ বিকৃতির প্রভাবে বানানেও অশুদ্ধি ঘটে।

সাম্প্রতিককালে বানান নিয়ে যে বিভ্রান্তি ও অনাচার লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে চলেছে, আসলে তার মূলে রয়েছে বানানের নিয়ম জানার ক্ষেত্রে আগ্রহ ও নিষ্ঠার অভাব। বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতিও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। ভাষা শুদ্ধ করে লেখার জন্য দরকার সামান্য আগ্রহ ও একটু মমতা।অবহেলাভরে বাংলা বানানের ভুলকে গ্রহণ করে নেবার এই মানসিকতা পরিহার করতে হবে।প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা বাংলাভাষার প্রতি বিশেষ আবেগ ও ভালোবাসায় উজ্জীবিত হই। সভা, সেমিনার, বইমেলা এবং বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা জানাই। শ্রদ্ধা জানাই বরকত, সালাম, রফিক ও জব্বারের মতো ভাষাশহীদদের। এ সময়টাতে আমাদের দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ নিয়েও সুন্দর একটা অনুভূতি জাগে। নতুন প্রজন্মকে আমরা আমাদের দেশপ্রেম ও মাতৃভাষার প্রতি আবেগ-অনুভূতির বার্তা পৌঁছে দেই। এ পুরো মাসটাতেই আমরা খাঁটি বাঙালি এবং বাংলাভাষার প্রতি আমাদের গভীর প্রেমের বন্দনা করি। আমাদের এ গতানুগতিক কর্মসূচির মধ্যেও আরও গতি পেয়েছে, যখন একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাভাষা এবং আমাদের বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে।
এত আলোচনা, আয়োজন এবং কর্মসূচির মধ্যেও প্রশ্ন জাগে, আমাদের এসব কর্মকাণ্ড কতটা আনুষ্ঠানিক আর কতটা আন্তরিক। তাছাড়া এ দিবসের তাৎপর্যকে আমরা কতটুকুই মনেপ্রাণে ধারণ করি।

পোস্টটি করেছেন Sumon Gang (মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ...!!!) পোস্টটি ভালো লাগলে কোন প্রকার লগইন ছাড়াই মন্তব্য প্রদান করুণ। কোন প্রকার অনৈতিক মন্তব্য প্রদান না করার জন্য বিশেষ ভাবে অনুরুধ করা যাচ্ছে।

No comments found.

New comment